Saturday, October 14, 2017

ক্ষত কে নিয়ে যাপন


ক্ষত কে নিয়ে  যাপন
স্মৃতির  মুকুল দিয়ে ,অন্তরপল্লিতে ঘর বেঁধে অযুত নিযুত কত মানুষ যে গৃহ থেকেও ,সুন্দর সংসার করেও আজ অন্যের আশ্রয়ে জীবন কাটান। কাটাতে বাধ্য হন। মনের মণিকোঠাতে এখনো সেই অতীত  খেলা করে অবিরাম। কিছু দিন আগেই এক বৃদ্ধাশ্রমে ,ভরপুর ভালোবাসা পেয়ে মনের কোনাতে নিজেকেই ওখানে খুঁজে যাচ্ছিলাম।

দশ জনের দশ রকমের বিচিত্র কাহিনী। কারুর সাথেই কারুর কোনো মিল বা অতীত মেলেনা। অথচ সবাই সুন্দর ভাবে রয়েছেন অনেক শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও। এনারা যে একে  অপরের সাথে থাকবেন , কল্পনাতেও  হয়তো ভাবেননি কখনো । জীবনের সায়াহ্নে নিজের আত্মজ  বা আত্মজা যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে ,তাহলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে কি করে থাকে ? পৃথিবীটাই তো মূল্যহীন হয়ে পরে।
তাঁদের সান্নিধ্যে কিছু সময় কাটিয়ে ,গল্প করে অন্য একটা পৃথিবীর খোঁজ পাওয়া যায়।

স্মৃতির কোলাজে  ঘুনে ধরেনা।অতীতের  অঙ্ক মেলেনা। ভুলে ভরা
উপলদ্ধির ওড়না যখন গেলো খুলে, জীবনের সায়াহ্নে সব ওলোট পালোট , মলাট পাল্টাতে পাল্টাতে ছিন্ন ভিন্ন। আর পাল্টানো দায়।

ওখানে  পেলাম কল্যাণী দত্ত দাস , রোজি ,আরো অনেক কেই । একজন চীনা মহিলাও আছেন। কেউ কেউ বেশ অসুস্থ , তবুও যখন আমি বললাম গান তো গাইতে হবে।  কে কে শুরু করবে? একজন যিনি চুপ করেই ছিলেন চেহারাতেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছাপ। সরু কালো পারের সাদা শাড়ি ,চোখে কালো ফ্রেমের চশমা , ঠিক মাতৃরূপী তাঁকেই চেপে ধরলাম। বললেন , সব ভুলে গেছিতো।  আমি বলি, তুমি শুরু করতো, তারপর দেখা যাবে---
উনি শুরু করলেন, ভারত আমার ভারত বর্ষ।
..
ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।
কৃতী ধরণী তুষার শৃঙ্গে সবুজ সাজানো তোমার দেশ।
 
তোমার উপমা তুমিই তো  মা , তোমার রূপের নাহিতো শেষ। 

তোমার সাহোন গহন তমসা সহসা ,নেমে আসে যদি আকাশ তোর।
হাতে হাত রেখে মিলি একসাথে ,আমরা আনিব নতুন ভোর।

ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।
ভারত শক্তি দায়িনী ,দাও মা শক্তি  ,ঘুচাও দীনতা  ভীরু আবেশ।
আঁধার রজনী ভয় কী জননী ,আমরা বাঁচাবো এ মহাদেশ। 

রবীন্দ্রনাথ ,বিবেকানন্দ ,বীর সুভাষ এর  মহান দেশ ,নাহিতো ভাবনা ,করিনা চিন্তা, হৃদয়ে নাহিতো ভয়ের লেশ।
ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।ভারত আমার ভারতবর্ষ ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো ,তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম,ধন্য হয়েছি ধন্য গো।
ধন্য হয়েছি ধন্য গো। ধন্য হয়েছি ধন্য গো। 

পুরোটা  শেষ করলেন--- আমি রুদ্ধশ্বাসে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিলাম।  
গলার কাছে একটা দলা অনুভব করছিলাম। তাকিয়ে ছিলাম ওনার দিকেই একদৃষ্টিতে। উনি গান শেষ করে মুচকি হাসলে আমার সম্বিৎ ফিরে  এলো , তালিয়া তালিয়া বলে চেঁচিয়ে উঠলাম উচ্ছাসে-- সবাই তখন করতালিতে ভরিয়ে দিলো। আমি অজান্তেই বলে ফেললাম ,"এখনো মনে হয় তোমার এই দেশে জন্মে ধন্য হয়েছো?"
উনি আমাকে স্তব্ধ করে দিলেন একটি কথা বলে ," কেন নয়? এখানেই তো তোমার মতো মেয়েরা আছে , আর সেই জন্যইতো এখনো বাঁচি। "
চোখের কোন ভোরে এলো ,নিজেকে আড়াল করে বললাম-- এরপর কে গাইবে?
অগত্যা আমি ধরলাম একটি গান আর সবাই একসাথে গাইবে কথা দিলো, আর গাইলো , "পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়ে ,সে যে চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কী ভোলা যায় ?............"

জীবনের এই কয় ঘন্টার প্রাপ্তি  অনেক নাপাওয়াকে কর্পূরের মতো উঠিয়ে দিলো।

রোজির  বিদেশী মা বাবা  এক  এংলো  পরিবারকে দত্তক দিয়েছিলেন।  সেখানেই সে বেড়ে ওঠে কন্যা হয়ে নয়, পরিচারিকা হয়ে। কথাবার্তাতে  ইংরেজিতেই স্বচ্ছন্দ। কারুর সাথে মিশতে দেয়া হতো না।
স্কুল যাওয়া ও মানা। দীর্ঘ এতগুলো বছর কাটানোর পর একটি দুর্ঘটনাতে কোমড়ের হাড় ভেঙে যাওয়াতে, সেই পরিবার রোজি কে হাসপাতালে পাঠিয়ে দায়মুক্ত হন। ওনার কোমরে এখনো প্লেট বসানো আছে। কিন্তু এতো হাসিখুশি আর ফিরে আসার সময় যখন বললো "come again" আমি বললাম "sure" বললে  , "May be you will come, but who knows by that time i might leave this world.".

আরো পেলাম চীন এর মহিলা।  তিনি হিন্দিতেই কথা বলেন, খুব মিষ্টি। প্রথমেই বললো চীনা চীনা , আর আমি বুঝলাম নাম বুঝি টিনা।  তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ তথ্য না থাকলেও তিনি ফুর্তিতে থাকেন-হাসি আর নাচ নিয়ে। কলকাতা শহরেই তাঁর পরিবারের সাথে থাকতেন এবং কাজকর্ম করতেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাদের কমিউনিটি ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন, কিন্তু সুস্থ হবার পর সেই কমিউনিটি ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করেন আর তখন থেকেই ওনার আস্তানা এইখানে। উনি আমাকে ওনার বাড়ির বিবরণ  দিচ্ছিলেন। কোথায় রুম, কোথায় বারান্দা, সেখান থেকে কি করে আরেকটা রুম এতে যাওয়া যায়,,ইত্যাদি।

বাকশূন্যহীন হয়েও অবিরাম হেসে হেসে আনন্দে আছেন একজন। ছবি তুলে ওনাকে দেখলেই উনি হেসে গড়িয়ে আরো তুলতে অনুরোধ করেন আর সেগুলো দেখে কি ফুর্তি। কেক আরেকটুরো দিতে গেলে ,বড়ো বড়ো  চোখ করে একগাল হেসে নিলেন।

কল্যাণী দত্ত /দাস এর চোখের অদ্ভুত জ্যোতি তে আমি মোহিত হয়ে বললাম , "খুব দুষ্টু  ছিলে , বোঝা যাচ্ছে।"
  মিটি মিটি হেসেই যাচ্ছে।  আমি বলি- "কয়টা প্রেম করেছিলে বলতো ? বলতে হবে- আড়াল করলে চলবেনা"। উনি বললেন , "নাগো, দাদা ভীষণ স্ট্রিক্ট ছিল , কড়া নজর আর পাহাড়াতে রাখতো ।  কোথাও একা একা ছাড়তোনা ,জানো ? তারপর তো বিয়ে হলো"।  বলি -"তা এখানেতো আনন্দেই আছো , দুষ্টামি  করছোনাতো" ?
বললেন সবাই খুব ভালো।  মাঝে মাঝে আমি একটু বেশি বিরক্ত করে ফেলি , রাতের বেলা গৌরীকে বলি বাথরুম যাবো।  ও কিন্তু কিচ্ছুটি বলেন। অনেক যত্ন করে আমার সাথে যায়। 

দুঃখের কথা হলো। ওনাকে যখন বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করলাম , কি সুন্দর করে জানালেন, মেয়ে কাছেই থাকে।  জানো , আমার নাতনি এবার মাধ্যমিক দেবে। ...অথচ ,পনেরো মিনিটের দূরত্বে  বাড়ি ,ওনার মেয়েকে যখন তার  মায়ের ছবি দেখিয়ে  জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সেই মেয়ে অস্বীকার করেছিল ,এমন কাউকে সে চেনেনা বলেছিল । 
কঠোর সত্যি  হলো , ওনার স্বামী ভালো কাজ করতেন , উনিও স্বামী বিয়োগের পর একটা স্কুলের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।  ছেলে কিছুটা বখাটে, সুরাসক্ত ।  বাড়ি বিক্রি করে যেই  টাকা পাওয়া গেছিলো তাতে ভালো ভাবেই স্বাচ্ছন্দেই চলে যাওয়া কথা ছিল। কিন্তু ভাড়া বাড়িতেও ভাড়া না দিতে পাড়ার দরুন  গৃহহারা হয়ে পথে , আর তারপর এইখানে সবার সাথে।
অনেক খোঁজা খুঁজির পর ছেলের সন্ধান পাওয়া গেলে মায়ের  বেশ মোট পেনশনের  কথা জানতে পেরে ওনার  অফিসিয়াল কাজ গুলো করতে  দ্বায়িত্ব নিতে রাজি  হয় সে ।  কিন্তু কিছুদিন আগেই অপঘাতে ছেলে মারা যায়। এইবার মেয়েকে এই দ্বায়িত্ব দেবার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন হোম কর্তৃপক্ষই। ছয়খানা উকিলের চিঠি পাবার পর তার সাড়া পাওয়া গেছে , শম্বুক গতিতে কবে এর সুরাহা হবে, অজানা।  
রাজস্থানের আজমের নিবাসী এক গোঁড়া হিন্দু পরিবারের জন্ম হওয়া আরেকজনকে পা ভাঙা ,চলৎশক্তিহীন অবস্থাতে লোরেটোর একজন কর্মী রাস্তার ধারে ওনাকে খুঁজে পায় দেড়মাস অধিককাল হাসপাতালে তার পায়ের ফিমার অস্থি জোড়া লাগানো হয়, চোখের অপারেশন ও হয়।  তারপর থেকেই এখানে আছেন।জানা যায় স্বচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তার আত্মীয় কুটুম্ব রা তাকে প্রাপ্য সম্পতি থেকে বঞ্চিত করেন।  ওনার সন্তান সন্ততির সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে চাননি। 
সম্পর্কের চাইতে বড়োতো  তার দায়বদ্ধতা ।।ভালোবাসার চাইতে বড়োতো  সততা।
ক্ষত কে পরিত্যাক্ত করার  দক্ষতায় পারদর্শিনী হয়ে উঠতে হয়েছে এঁনাদের ।
ক্ষত তে আলিঙ্গনের স্পর্শ দিয়ে মমত্ব দিয়ে  রাখেন  জড়িয়ে।  আধপোড়া সুখ আর বিষাদময় অতীতের আর্তনাদ ছাঁকনি দিয়ে ছাকেন নিত্য।মরমের ঘরে ঝুলছে তালা,ক্ষত কে নিয়ে  যাপন।নি:শব্দের ভেতরে শব্দ খেলা করে অবিরাম। ----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
Sent on 20th Sept 2017








Bhalo thakar bikalpo nei, kharap tai thakte nei.........

জীবন সুধা করে পান , আনন্দে গ্রহণ করি সব দান ,
মিছি মিছি কেন আহা দুখকে অপবাদ দিয়ে কারো অপমান ?
সুখ পাখি ডানা ঝাপটে সদাই দায়ে জানান -- জীবনের দাম !
কষ্ট কে ঠেলবে যত দূরে , সে আসবে ধেয়ে ...
তাকেও দিয়ে সম্মান ,জীবনকে কে করি চলো আনন্দের বাগান


অনেক অনেক কথা

অনেক অনেক কথা
লিখব বলে এলাম চলে -অনেক অনেক কথা ...তোময়ে পেয়ে ভুলে গেলাম যত মনের ব্যথা ........

তুমি শুধু

তুমি শুধু
তুমি শুধু থেকো মোর মনের ঈশান কোণে.....সব কিছু তুচ্ছ করে ভালো বাসবো জীবনকে ...এলোমেলো জীবন আমি সাজবো প্রাণ ভরে ...বাঁচব আবার নতুন করে ,নতুন উদ্দমে..

Followers

Blog Archive

Powered By Blogger